Menu:

বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধ

রাবি’র শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা

Picture
রুহুল আমীন হৃদয়

বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। আর এই মহান ভাষা বাংলাকে বাংলাদেশে স্থায়িভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিলিয়ে দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। বলা হয় সেই আন্দোলনের পটভুমিতেই রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মতিহারের সবুজ চত্বরে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেমন প্রতিটি মানুষের চোখ জুড়িয়ে দেয় তেমনি এখানকার অবকাঠামোগুলোও হৃদয়কে পুলকিত করে তোলে। তেমনই একটি অবকাঠামো  হচ্ছে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট দিয়ে ঢুকে ডান দিকে যেতেই চোখে পড়বে সুবিশাল শহীদ মিনার। এরই পাদদেশে ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি দেশের প্রথম মুক্তযুদ্ধ ভিত্তিক এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন তিন শহীদ শিক্ষক পতœী বেগম ওয়াহিদা রহমান, বেগম মাস্তুরা খানম এবং শ্রীমতি চম্পা সমাদ্দার। শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায় এর তৈরী শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চের গ্রীণরুমেই এই সংগ্রশালা গড়ে উঠে। ২১ ফেব্র“য়ারী ১৯৭৬ সালে সংগ্রহশালাটি প্রথম দর্শকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। একই বছর তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল ৬ মার্চ সংগ্রহশালার প্রথম উদ্বোধন করেন। নির্ধারিত স্থান না থাকায় শুধু বছরের বিশেষ দিনগুলোতে (২১ ফেব্র“য়ারি ২৬ মার্চ ১৬ ডিসেম্বর) এটা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হত। এরপর ২২ মার্চ, ১৯৮৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আমানুলাহ আহমদ সংগ্রহশালার মূল ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এর আয়তন ৬ হাজার ৬শ বর্গফুট। এতে ৩টি গ্যালারী রয়েছে। গ্যালারীগুলো নান্দনিক-নৈপূণ্য ও সমৃদ্ধ স্থাপত্যের প্রতীক। এখানে ’৫২, ’৬৬, ’৬৯ ও ’৭১ সালের আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন সংগৃহীত নিদর্শন পর্যায়ক্রমে স্থান পেয়েছে।
প্রথম গ্যালারীতে  ৫৯টি আলোকচিত্র, ৬টি প্রতিকৃতি, ২টি কোলাজ, ৮টি শিল্পকর্ম, ৭টি পোশাক ও অন্যান্য বস্তু, ১টি ভাস্কর্য, ৪টি ডায়েরী ও অন্যান্য পান্ডুলিপি  এবং ২টি বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র  রয়েছে। এতে আরো রয়েছে ২১শে ফেব্র“য়ারী ৫২’র রাতেই রাজশাহীতে (রাজশাহী কলেজ হোস্টেল গেটে) নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, আমতলা সভা, ২১শে ফেব্র“য়ারি ৫২’র কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল, ২১শে ফেব্র“য়ারি ৫২’র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি, নগ্নপদ মিছিল, ৫৩’র শহীদ মিনার, ২১শে ফেব্র“য়ারি ৫৩’র ঢাকা হল, ১৯৬৯ এর গণ-বিক্ষোভের মুখে পুলিশ বাহিনী ৬৯, বিক্ষুব্ধ জনতা ও ব্যারিকেড ৬৯, শহীদ আসাদ, শহীদ মতিউর, শহীদ রফিক, বরকত, সালাম ও শহীদ শামসুজ্জোহার প্রতিকৃতি, মিছিলের অগ্রভাবে ডঃ জোহা ২১শে ফেব্র“য়ারী ৫৩, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মিছিল ৬৯ যে মিছিলে গুলিবব্ধ ডঃ জোহা, হাসপাতালে, মৃত অবস্থায় জোহা, কবরে শায়িত ডঃ জোহা ও ৭০ এর প্রার্থনা। এছাড়াও প্রখ্যাত শিল্পী মোস্তফা মনোয়ারের শিল্পকর্ম, সুজা হায়দার এর বর্ণমালা, অসহায় আত্মা আবু তাহের, উত্তমদের কোলাজ-মুক্তিযোদ্ধার শার্ট, প্রণব দাসের ভাস্কর্য আর্তনাদ উল্লেখযোগ্য।

দ্বিতীয় গ্যালারীতে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, ৯টি শিল্পীকর্ম, ১৯টি বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, ৩টি ভাস্কর্য, ৯৯টি পোশাক ও অন্যান্য বস্তুু  ও ৫টি ডায়েরী । এখানে আরো আছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ ও সমর নায়ক জাতীয় ৪ নেতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ শিক্ষককের প্রতিকৃতি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষনা বাণীর প্রতিলিপি, মুজিব নগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ঢাকার রাজপথ, গণ-বিক্ষোভ ৭১, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ৭১ ছাত্রী নিগ্রহ, বাংলার ধর্ষিতা মাতা-জায়া, গণহত্যা, ২৫ মার্চের কালো রাত, ঢাকার রাজপথ ৭১, আত্মসমর্পন দলিলের চুক্তিপত্র, বাঁধাইকৃত মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোষ্টার-আমরা সবাই বাঙ্গালী, বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা, সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী, শিল্পী রফিকুন্নবীর একাত্তর ফেরা, শিল্পী হাসেম খানের বাংলাদেশ ডিসেম্বর, মাহমুদুল হকের ৭১ দূর্ভিক্ষ, আবদুর রাজ্জাকের ভাস্কর্য একজন মুক্তিযোদ্ধা, শহীদদের পোশাক ও অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিস, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ডায়েরী ও পান্ডুলিপি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহীর শহীদদের ছবি, আলোকচিত্র ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র উল্লেখযোগ্য।
তৃতীয় গ্যালারীতে রয়েছে ১১২টি আলোকচিত্র, ১টি প্রতিকৃতি, ১১টি শিল্পীকর্ম, ১টি বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, ৬টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরী ও পান্ডুলিপি, ৫৬টি পোশাক ও অন্যান্য বস্তু। এখানে আরও রয়েছে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল চিত্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, বিজয়ী মুক্তিসেনা, হানাদারমুক্ত ঢাকা শহর, গণকবর, বুদ্ধিজীবী হত্যা, রায়ের বাজার ঢাকা, বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত মাইন, বুলেট, রকেট লাঞ্চার পেশসহ বিভিন্ন অস্ত্র। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ সাংবাদিকদের ছবিসহ বন্ধবন্ধু সম্পর্কিত একটি আলাদা বোর্ড, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গণকবর থেকে প্রাপ্ত ও অন্যান্য নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলি-হাঁড়-গোড় ও ব্যক্তিগত ব্যবহৃত জিনিসপত্র, শিল্পী কামরুল হাসানের মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোষ্টার “এ্যানিহিলেট দিজ ডেমনস”  শিল্পী আমিনুল ইসলামের শ্বেতপত্র ৭১ চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
এ সংগ্রহশালার অন্যান্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ অনুপ্রাণিত তৈল চিত্র, ছাপচিত্র ও জলরং চিত্রের সংগ্রহ। বাংলাদেশের প্রধান চিত্রশিল্পীবৃন্দ যাদের শিল্পকর্ম এই সংগ্রহের মাঝে স্থান পেয়েছে তাঁদের মধ্যে আছেন- আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, রফিকুন্নবী, হাসেম খান, মোস্তফা মনোয়ার, রশীদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী।
সংগ্রহশালার একটি বিশেষ অংশ জুড়ে রয়েছে গবেষকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা পাঠাগার। প্রতিবছর  এম ফিল ও পি এইচ.ডি গবেষকরা গবেষণা কাজে এই পাঠাগারটি ব্যবহার করেন। এখানে আরও রয়েছে ১৯৪৭-১৯৭১ এর উপর প্রায় ৩০০০ কপি বই, পুস্তিকা, ইশতেহার ও সংকলন। বইয়ের পাশাপাশি এখানে উল্লিখিত সময়ের কিছু পত্রিকা বাঁধাইকৃত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ভাষা আন্দোলন, গণ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পত্রিকার কাটিং ফাইল। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধের নানা অধ্যায়ের স্মৃতি নিদর্শন পরম যতেœ সংরক্ষণ করছে এই সংগ্রহশালা।
বিভিন্ন সময়ে বাঙালি জাতির যে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন রয়েছে তা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই এই সংগ্রহশালার মূল উদ্দেশ্য। ভবন সম্প্রসারণ, আলাদা পাঠাগার ও ইন্টারনেট সংযোগসহ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে রাবির শহীদ স্মৃতি সংগ্রশালার দর্শকদের কাছে হয়ে উঠতে পারে আরো নান্দনিক,অর্থবহ ও অনন্য নিদর্শন। ফিচার পাতা